গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে লেদার ইঞ্জনিয়ারিং- ইয়াং লেদার সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’ বিজয়ী Md. Shahruk Nur-A-Tomal
0
January 29, 2018
-সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি; সময় পাখা মেলার, উঁচু হয়ে স্বপ্ন দেখার। তখন খুব দৈনিক পত্রিকা পড়া হতো। মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দারুণ সফলতা দেখাচ্ছেন। এগুলো দেখে মাঝেমধ্যে হতাশই হতাম। কারণ, আমি তো ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ি না যে রোবট, ড্রোন ও সোলার সিস্টেম ইত্যাদি বানাব। তাই বলে কি থেমে থাকব?
--না। অনেকের কাছেই শুনতাম গবেষণাপত্র থাকলে বিদেশে গ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তি হতে সুবিধা হয়। যেহেতু কৈশোর থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার ইচ্ছা ছিল, তাই গবেষণায় সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। সে জন্য তখন খুব পড়াশোনা করতাম; লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ্যবই, বিভিন্ন গবেষকের প্রকাশিত গবেষণাপত্র, প্রতিবেদন ইত্যাদি। জানার চেষ্টা করতাম ইতিমধ্যেই পৃথিবী কত দূর এগিয়েছে। কী কী কাজ হয়েছে আর কত কিছু নিয়ে ভাবার আছে। বুঝতে পারলামগবেষণাকাজ শুরুর আগে সেসব বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা খুব জরুরি। আর নতুন ধারণা বিকাশের জন্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
--গবেষণার সবচেয়ে সুবিধা হলো কোনো কিছু মুখস্থ করতে হয় না। যখন যে তথ্যের প্রয়োজন হয়, সেটা জেনে নিলেই হয়। গবেষণার বিষয় হিসেবে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রধানত কেমিস্ট্রি-নির্ভর হলেও বায়োলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত। আর এ পর্যন্ত খুব কম গবেষণাই সম্পাদিত হয়েছে এই বিষয়ে। তাই গবেষণা করার অসংখ্য দ্বার খোলা আছে।
--নতুন গবেষকেরা প্রথমেই যে সমস্যায় পড়েন সেটা হলো, প্রয়োজনীয় আর্টিকেল ডাউনলোড করার অ্যাকসেস না থাকা। আমি দুভাবে জার্নাল আর্টিকেল সংগ্রহ করতাম। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুকে অনেক গ্রুপ আছে, যেখানে আর্টিকেল পাঠানোর অনুরোধ করলে স্বেচ্ছাসেবকেরা ই-মেইল বা ইনবক্সে পাঠিয়ে দেন। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে না পেলে সরাসরি আর্টিকেলের লেখককেই ই-মেইল করে আর্টিকেল পাঠানোর অনুরোধ করতাম। অধিকাংশ লেখকই আর্টিকেল পাঠিয়ে দিতেন।
--গবেষণাকাজে সফল হওয়ার জন্য দুটি গুণ থাকা অত্যাবশ্যকীয়, সেগুলো হলো: ধৈর্য আর বিশ্লেষণের ক্ষমতা। ভালো মানের গবেষণা সমাপ্ত করতে অনেক সময় লাগে। আর আপনি তাত্ত্বিকভাবে যা ভেবে রেখেছেন, কার্যকরভাবে সেই ফলাফল প্রথমে না-ও পেতে পারেন। তাই ধৈর্য ধারণ করে গবেষণাকাজটি সঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার সময় বিভিন্ন সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। গবেষণায় কী ভুল হচ্ছে, তা শনাক্ত করতে পারা অত্যন্ত কঠিন। সমস্যা শনাক্ত করা এবং সেই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নানা সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা খুব কাজে লাগে।
--আমার সাফল্যের পেছনে মূল অবদান রেখেছেন আমাদের খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল হাসেম স্যার। যিনি আমাকে হাতে-কলমে গবেষণা শিখিয়েছেন, বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, তিনি আমাকে কোনো কাজে না করেননি, যদিও জানতেন আমি ভুল করছি। মানুষ তো ভুল থেকেই ভালোটা শেখে। আপনি যদি কোনো ভুল না করেন, তাহলে মোটামুটি বুঝে নেবেন আপনার কাজটি সঠিক দিকে এগোচ্ছে না। ভুল আপনাকে একদিন সফলতা এনে দেবেই।
--দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। আর নবীনেরা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জোগাড় করতে রীতিমতো হিমশিম খায়। তাই বলে কি আমাদের কিছুই করার নেই? অবশ্যই আছে। আমাদের বাস্তবতা মেনে নিয়েই যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে; বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরার যুদ্ধে। কম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে কিছু করে দেখাতে পারাটা সবচেয়ে বড় রকমের সফলতা।
-আমরা নতুন কোনো গবেষণা শুরু করার আগে বারবার দেখে নিতাম গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামাদি আমাদের গবেষণাগারে উপস্থিত আছে কি না বা সহজলভ্য কি না? অনেক ছাত্রছাত্রীই চমৎকার নতুন ধারণা বের করে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারে না বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্য। শুধু নতুন ধারণা বিকাশ করলেই হবে না, সেটা বাস্তবায়ন করে দেখালেই তো উদ্দেশ্য সফল হবে।
--অনেকের ভুল ধারণা আছে, গবেষণা যত দুর্বোধ্য বা জটিল হবে, সেটা তত ভালো মানের। ভালো মানের গবেষণা যে দুর্বোধ্য বা জটিল হতে হবে, তা অত্যাবশ্যকীয় নয়। আমার প্রায় সব গবেষণাকর্মই সহজ-সরল। কিন্তু সব কটিই ভালো ভালো জার্নাল বা কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়েছে এমনকি পুরস্কারও পেয়েছি। সরলভাবে চিন্তাভাবনা করাটাকে আমি তাই প্রয়োজনীয় মনে করি। পৃথিবীর অনেক মহান মহান আবিষ্কারের প্রথম সূত্রই এসেছে অতি সরল বা নৈমিত্তিক ঘটনার মাঝেই। সরল সব ঘটনার মাঝেই পৃথিবীর অসামান্য সব আবিষ্কারের বীজ রেখে দিয়েছে। সরল জিনিসকে বা সরলভাবে ভাবতে পারার ব্যাপারকে আমি তাই অত্যন্ত জরুরি মনে করি।
--যদিও প্রথমে দু-একটা আর্টিকেল প্রকাশ করার জন্য গবেষণা শুরু করি। কিন্তু কখন যে গবেষণা ভালো লাগা শুরু করেছে বুঝতে পারিনি। সত্যি বলতে আমি ব্যক্তিজীবনে খুব অলস। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে কোনো সময় আলসেমি আসেনি। এর নামই মনে হয় ‘প্যাশন’। চামড়া আর কেমিক্যালের গন্ধে ভরে থাকা গবেষণাগারে কত সময় পার করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। কত কিছু জীবন থেকে ত্যাগ করেছি, তার হিসাব নাই-বা দিলাম।
--মানুষের সাফল্য দেখে কখনো কখনো নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। বিশেষ করে কারও নামের সামনে ‘বিজ্ঞানী’ দেখলে খুব কষ্ট পেতাম। কেন আমার নামের সঙ্গে নেই! ‘ইয়াং লেদার সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’ সম্পর্কে জানার পর নিজের মনের ইচ্ছাগুলো স্বপ্নে পরিণত হওয়া শুরু করে। সারা বিশ্ব থেকে একজনই এই পুরস্কার পান বলে খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। তবু স্বপ্ন দেখতাম, স্বপ্নের তো কোনো সীমানা নেই, কখনো কখনো যুক্তিও থাকে না। কিন্তু আমি জানতাম, চেষ্টা সীমানা স্পর্শ করতে পারে, চেষ্টা স্বপ্নকে যৌক্তিক করতে পারে। চেষ্টার উপহার হিসেবে আল্লাহ মানুষকে অনেক কিছুই দেন। তেমনি লবণ ছাড়া চামড়া সংরক্ষণের উপায় বের করে তরুণ বিজ্ঞানী খেতাব পাই। গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিতে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব লেদার টেকনোলজিস্ট অ্যান্ড কেমিস্ট সোসাইটিজের (আইইউএলটিসিএস) কাছে থেকে এক হাজার ইউরো পাই। আমি জানি, আমার কিছুই করা হয়নি এখনো, কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী এই কারণে যে পরিশ্রম করে যাওয়ার ধৈর্য আয়ত্ত করতে শিখেছি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পুঁজি।
--উপযুক্ত স্বপ্ন বেছে নিয়ে, সেই স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য মাঠে নেমে পড়ুন। বিশ্বদরবারে নিজেকে,নিজেরপরিবারকে,দেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করলে আপনি একদিন সফল হবেনই। স্বপ্ন যেকোনো কিছুকে সম্ভব করে তোলে। স্বপ্ন দেখুন, অনেক বড় স্বপ্ন দেখুন
সফলতা পাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কাজের জন্য সময় দেওয়া। যত সময় দরকার, ততই দিতে হবে। কত সময় দিচ্ছেন গবেষণাটি করার জন্য, সেটা ভুলে যান। আপনার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যান। ছোট ছোট কাজগুলো সময়ের আবর্তে কখন অনেক বড় হয়ে গেছে, নিজেই কল্পনা করতে পারবেন না।
--শুধু গবেষণাগারে কাজ করলেই শেষ নয়, গবেষণাটি জার্নাল বা কনফারেন্সে প্রকাশ করতে হয়। গবেষণাগারে কাজ করার চেয়ে কাজটি উপযুক্তভাবে লিখে প্রকাশ করতে বেশি বেগ পেতে হয়। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইংরেজি মিশিয়ে ফেলা আর লেখার মানও খারাপ। কীভাবে ভালো গবেষণাপত্র লেখা যায়, তা শেখা খুবই দরকার। ভালো লেখা গবেষণার মান অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা অনেক সময় হতাশার বৃত্তে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলি, যার কারণ হিসেবে নিজের বর্তমান অবস্থাকে দায়ী করি। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যে অবস্থায় রয়েছে, সেই অবস্থাটিকে যদি মনে-প্রাণে সম্মান ও ভালোবাসতে পারে, তাহলে সেই অবস্থানটিই তাকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। নিজের অবস্থানকে পুঁজি করে নিজের পরিশ্রমকে সঙ্গী করে সূচনা হতে পারে নতুন দিগন্তের।
--অনেক কাজেই আপনার ব্যর্থতা আসতে পারে। ব্যর্থ হলে হতাশ না হয়ে ঘুরে দাঁড়ান। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করুন। আমি মনে করি, প্রত্যেকের সফলতার জন্য মানসিক সমর্থন অপরিহার্য। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখুন। বন্ধু প্রিয়জনদের নিজের পাশেই রাখুন। সব সময় মনে রাখবেন সব সমস্যার সমাধান আছে। কিছু সমস্যার সমাধান পড়ালেখায়, কিছু সমস্যার সমাধান কাজে, কিছু সমস্যার সমাধান অভিজ্ঞদের আলাপনে, আবার মানসিক কিছু সমস্যার সমাধান আপনার প্রিয়জনেরাই দিতে পারেন।
--তবে মানুষ অনেক সময় আপনাকে নিয়ে অনেক কিছুই বলবে। সেগুলো কানে না নিয়ে আপনার নিজের মন যা ভালো মনে করে, সেটা করুন। মানুষের কাজই সমালোচনা করা। আর কেউ নিন্দা করলে আপনারই ভালো; আপনার ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পাচ্ছেন।
--আকাশের বিশালতা যেমন, স্বপ্নও তেমন অজস্র। কোনটা নিজের জন্য উপযোগী, সেটা বুঝতে পারাই চ্যালেঞ্জ। নিজেকে বুঝতে পারা, নিজের সম্ভাবনাকে বুঝতে পারা, নিজের কাজের পথকে চিনতে পারাও সাফল্যের প্রথম পাঠ বলে আমি মনে করি। উপযুক্ত স্বপ্ন বেছে নিয়ে, সেই স্বপ্ন বাস্তব করার জন্য মাঠে নেমে পড়ুন। বিশ্বদরবারে নিজেকে,নিজেরপরিবারকে,দেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করলে আপনি একদিন সফল হবেনই। স্বপ্ন যেকোনো কিছুকে সম্ভব করে তোলে। স্বপ্ন দেখুন, অনেক বড় স্বপ্ন দেখুন।
Md. Shahruk Nur-A-Tomal
তরুণ বিজ্ঞানী (প্রাক্তন ছাত্র (2K11 Batch), লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কুয়েট)
‘ইয়াং লেদার সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড’ বিজয়ী