একইসাথে অনেকগুলা ঘটনা ঘটে থাকে। একই কথারও অনেকগুলা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু মূল ব্যাপার হল আপনি কোন ব্যাপারটাকে ফোকাসে রাখবেন।
যেকোনো ক্ষেত্রে ফোকাসিং ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফোকাস সরে গেলেই আপনার মূল উদ্দেশ্য অন্যদিকে মোড় নিবে।
ফোকাসিং ব্যাপারটা কি, তা সহজে বোঝানোর জন্য আমি সেমিস্টার এর সাব্জেক্টগুলোর উদাহরণ দিতে পারি। যেমন এক সেমিস্টার এ ৫ টা সাব্জেক্ট আছে। এর মধ্যে কোনোটার ৪ ক্রেডিট, কোনোটার ৩,২,১.৫, ১ এরকমভাবে।
এখানে ৪ ক্রেডিট দ্বারা বোঝানো হচ্ছে এটাই আপনার আসল উদ্দেশ্য। এই সাব্জেক্ট ভালোভাবে জানা আবশ্যক। অথচ পাস করতে হলে বাকি সাব্জেক্টগুলোও জানতে হবে। কিন্তু যখন ৪ ক্রেডিট রেখে আপনি ১.৫ ক্রেডিটের সাব্জেক্ট এ সিরিয়াস হয়ে যাবেন, তখনি বিপদ।
যেমনটা আমরা প্রতিদিন আমাদের জাতীয় জীবনে দেখতে পাই।
সাধারণত, মানুষ মুখরোচক খবর পছন্দ করে। মুখরোচকের সহজ সংজ্ঞা হল - অন্যের দুর্নাম করে মজা লুটা।
এবং এর ফলে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়, তা হল ডিফোকাসিং।
কিছুদিন আগে ভি আই পি লেন নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যে ব্যাপারটা নিয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে, তা হল দেড় ক্রেডিটের সাব্জেক্ট। ৪ ক্রেডিট আড়ালে চলে গেছে।
মূল ব্যাপার ছিলো - জরুরী যানবাহন, যেমন - এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, এদের জন্য আলাদা লেন এর ব্যবস্থা করা, যাতে জ্যাম থেকে বেচে সহজে অন্য পথ দিয়ে যাওয়া যায়। সেই পথে চাইলে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির গাড়িও চালানো যাবে, তবে সেটা ৩ ক্রেডিট এর ব্যাপার।
কিন্তু আলোচনায় মূল ব্যাপারটা বাদ দিয়ে চলে আসলো পরের ব্যাপারটা। সবাই যে যার মতো গালি দেওয়া শুরু করলো এবং মূল ব্যাপারটা আলোচনার বাইরেই থেকে গেলো। হয়ে গেলো ডিফোকাসড ন্যাশন।
দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের সাথে বাংলাদেশের ইস্যুগুলাও দ্রুত পরিবর্তনশীল। কেননা আমরা এখনো শিখিনী কোন ব্যাপারটা না দেখার ভান করতে হবে আর কোন ব্যাপারটা আঁকড়ে ধরতে হবে।
সংবিধান, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক চুক্তি, এই ব্যাপারগুলো আমাদের চোখের ঠিক নিচে নাকের পাশ দিয়ে পার হয়ে যায়। কিন্তু আমরা নাকের জন্য চোখে দেখছিনা।
কারণ অধিকাংশ মানুষ নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন নন। আর যারা এসবের খোজ রাখেন, তারাও এসব নিয়ে কথা বলতে চান না, একদিকে ৫৭ দ্বারা, অন্যদিকে নতুন সৃষ্ট আড়িপাতা বিরোধী আইন।
তাছাড়া গত ৯ বছরে অধিকার নিয়ে কোন আন্দোলন সফল হবার নজির নেই। বাতিল হয়নি ফাস হওয়া প্রশ্নে হওয়া মেডিকেল সহ অন্যান্য পরিক্ষা। বরং শুনতে হয়েছে এসব গুজব। তাই যারা এসব নিয়ে লেখেন, তারাও এব্যাপারে আর আগ্রহ পাননা। আমি নিজেও লাস্ট কবে লিখেছি মনে নেই। কারণ এখানে সত্য বলা মানে শত্রু বাড়ানো, অথেতুক যেটার দরকার নেই।
যাইহোক, ফোকাসিং নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি নিজেও ডিফোকাসড হয়ে যাচ্ছিলাম।
ফোকাসিং ব্যাপারটা কন্ট্রোল করতে পারাটাও একটা বড় গুণ। আমার ভাষায় এটাই প্রফেশনালিজম।
এর মানে হল আপনার মূল কাজটাই শুধু অন্যদের সামনে প্রদর্শন করা, বাকি সবকিছু আড়ালে রাখা। তা না হলে বহুবিপদ।
যেব্যাপারটা ঘটেছে হুমায়ুন আহমেদ এর ক্ষেত্রে।
আমার মতে, প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবন থাকা উচিৎ পর্দার আড়ালে। বাইরের মানুষ শুধু আপনার কাজ দেখতে পাবে। যখন এর ব্যত্যয় হবে, তখনি হবে ডিফোকাসড।
সাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ুন আহমেদ অতুলনীয়। কিন্তু প্রব্লেম তখনি, যখন সাহিত্যের সাথে তার ব্যক্তিগত জীবন জড়িয়ে পড়ে।
ফলে মানুষ ডিফোকাসড হয়ে সাহিত্যের বদলে তার ব্যক্তিগত কাজ দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করা শুরু করে। এতেই তিনি চলে যান অনেকের অপছন্দের তালিকায়। কিন্তু যদি এই ব্যাপারে দুই এর মাঝে দুরত্ব রাখতে পারতেন, আমার মনে হয় সেটাই ভালো হত।
একই কথা প্রযোজ্য সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে। তার খেলা বা দক্ষতা নিয়ে কখনো সংশয় নেই। তাহলে তার থাকার কথা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। অথচ যখন তিনি পাবলিক ফিগার হয়ে পার্সোনাল লাইফ পাবলিক করা শুরু করলেন, তখনি ঘটলো ব্যত্যয়।
এরকম উদাহরণ অসংখ্য আছে। কিন্তু আমি যে ব্যাপারটা বলতে চাচ্ছি, প্রফেশনালিজম। মানুষ আপনাকে কিরকম ভাববে, তা আপনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আপনি যদি চান অন্যরা আপনার কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করুক, তাহলে নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে আড়ালে রাখাটাই ম্যাচুরিটি।
মানুষ দেখে আউটপুট। আমি যদি বলি, স্কয়ার, প্রাণ, সিম্পনি, ওয়ালটন বা এরকম প্রতিষ্ঠানগুলো, সেখানকার পিছনের মানুষগুলোর কথা কিন্তু খুব কম জানি । কোম্পানিগুলোর হেডকে চিনি, কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত জীবন কখনওই আমরা দেখতে পাইনা। ফলে আমাদের ফোকাস সবসময় কাজের উপর থাকে, ডিফোকাসড হবার সম্ভবনা কম।
যেকোনো ব্যাপার দুভাবে বর্ণনা করা যায়। সিরিয়াসলি সেই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা। অথবা সেটাকে ব্যঙ্গভাবে উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্টদের হেয় করে কাজ করা।
উদাহরণ দিই, প্রশ্নফাস এখন সবার মুখে। কিন্তু তবুও এটাকে আমি জাতীয় ইস্যু বলবোনা, কারণ সরকার ও উর্ধতন কর্তারা সরাসরি না বলে দিয়েছে এবং আমি জানি অন্তত এই সরকারের মেয়াধে এটা বন্ধ হবেনা। কেন বন্ধ হবেনা সেটা শিক্ষক দিবসে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে লিখেছিলাম। যাক সে কথা।
প্রশ্নফাস নিয়ে আমরা দুটো কাজ করছি। প্রথমত অনেকেই সিরিয়াসভাবে সমালোচনা করছেন। কিন্তু যাদের সমালোচনা হচ্ছে তারা সরাসরি নাকোচ করায় এটা আগানোর কোনো সম্ভাবনা নেই।
২য়ত অনেকেই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এর আচরণ ও কথাবার্তা নিয়ে ট্রল করছে।
দুটোই প্রতিবাদ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয়টা বেশী চলছে। এবং এভাবেই একটি সিরিয়াস ব্যাপার ট্রল হয়ে ফোকাস থেকে হারিয়ে যাবে। কারণ হাসিঠাট্টাও বেশিদিন ভালো লাগেনা।
যেরকম হয়েছে অন্যান্য ইস্যুগুলোতেও। এটার ক্ষেত্রেও হবে। ২০০০ সাল পূর্ববর্তী সময়ের মতো প্রশ্নফাসও স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে এবং তখন কেউ আর এটাকে কোনো প্রব্লেমই মনে করবেনা।
যুগ যুগ করে জাতি এভাবেই ডিফোকাসড হতে থাকবে। তবে সেটা অস্বাভাবিকও নয়। যেখানে সুশাসন এবং মূল্যবোধ নেই, সেখানে সুবিচার থাকেনা এবং নেইও। তাই ডিফোকাসড হয়ে দ্রুত নতুন নতুন বিনোদনে মেতে উঠলে দোষ কোথায়??
মুহাম্মদ মাহদী হাসান সৈকত, ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ