শীতের আকর্ষণ খেজুরের রস। অথচ এই রস হতে পারে শত শত মানুষের মৃত্যুর কারন। ফরিদপুরের ঘটনা। স্কুল পড়ুয়া একটি মেয়ে খেজুরের রস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু অসুস্থতার কারন খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে জানা গেল মেয়েটি নিপা (Henipah) ভাইরাসে আক্রান্ত। মেয়েটি মারা যায়। মেয়েটির বাবা মা মেয়েটির সেবা শুশ্রূষা করতে যেয়েও মারা যায়। একই পরিবার থেকে ৪ জনের মৃত্যু হয়। এমনকি যেই রিকশাওয়ালা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল সেও আক্রান্ত হয় এবং মারা যায়।
খুব সম্ভবত মানিকগঞ্জের ঘটনা। একটি মেয়ে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়। ডাক্তার তার পিতা মাতাকে বলে যে কোন ভাবেই যেন মেয়ের কাছে না যায়। কিন্তু তারা ডাক্তারের কথা শুনেনি। মেয়ের কাছ থেকে তারাও আক্রান্ত হয়। তারা সবাই মারা যান। এমনকি লাশ গোসল করিয়েছিল যারা তারাও আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ঠিক এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গর্ব একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। IEDCR এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুরান ঢাকায় একবার দেখা যায় হঠাৎ বেশ কয়েকটি বানর মারা যায়। এই সংবাদ IEDCR এর কাছে পৌছে। দ্রুত তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে অনুসন্ধানে নেমে পড়ে। কোন এক মুরগির খামারের মুরগি গুলোকে চেক করতে যেয়ে বার্ড ফ্লু ধরা পড়ে। সাথে সাথে পুরো এলাকা কুয়ারেন্টিন ঘোষনা করে সভ গুলি মুরগি কে ধ্বংস করা হয়। সেই সাথে ভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে সেই ব্যাবস্থা নেয়া হয়। ফলাফল হল বার্ড ফ্লু কে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়।
বার্ড ফ্লু ধ্বংশের জন্য সারা দেশেই তারা অপারেশন চালায়৷ এবং আক্রান্ত মুরগি বা পাখি গুলোকে নিয়ন্ত্রিত ভাবে মেরে ফেলে এর বিস্তার রোধ করে।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে যেকোন ভাইরাল আউটব্রেক হলে সেটা ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। হতে পারে শত শত মানুষের মৃত্যু। আমরা আফ্রিকায় দেখেছি ইবোলা ভাইরাস শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের এই প্রতিষ্ঠানের নিরলস পরিশ্রমে এদেশের যেকোন ভাইরাল আউটব্রেক নিয়ন্ত্রন করা গেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা নিয়ে আমরা অনেকে বাজে ধারণা পোষন করি। কিন্তু এদেশের যেকোন অঞ্চলে কোন হাসপাতালে যদি একি ধরনের রোগের কেস বার বার আসতে থাকে এবং কোন সমাধান করা না যায় দ্রুত IEDCR কে জানাতে হয়। সংশ্লিষ্ট ডাক্তার যদি সেটা রিপোর্ট না করেন তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান ও রাখা হয়েছে। আর এরকম ক্ষেত্রে তড়িৎ গতিতে রেস্পন্স করে IEDCR।
যে কথাটি জানানোর জন্য এই লেখা, সেটা হল, হলিউডের বদৌলতে Center for disease Control বা CDC কে চেনেনা এমন মানুষ কম আছে। হেলিক্স, দ্যা লাস্ট শিপ, ওয়াকিং ডেড, দ্যা স্ট্রেইন, রেসিডেন্ট এভিল এর মত বিভিন্ন সিরিয়াল এবং মুভিতে দেখা যায় কোন ভাইরাস আউটব্রেক হলেই সেখানে সিডিসি হাজির।
সাধারণত সিডিসি সারা বিশ্বে যেকোন আউটব্রেক আগে থেকে চিহ্নিত করবার জন্য গ্লোবাল ডিজিস ডিটেকশন প্রোগ্রাম (Global Disease Detection Program) চালু করেছে। সারা বিশ্বে তাদের মোট ১০ টি গ্লোবাল ডিজিস ডিটেকশন সেন্টার রয়েছে। এই ১০ টা সেন্টারের একটা বাংলাদেশ। এছাড়া এই অঞ্চলে এই সেন্টার আছে শুধু চীন এবং ইন্ডীয়ায়।
ইন্সটিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড রিসার্স (Institute of Epidemiology,Disease Control and Research) সংক্ষেপে আইইডিসিআর (IEDCR) হল বাংলাদেশের সিডিসি। অনেকেই হয়ত এর নাম শুনেনি। হলিউডের মত মুভি বানানোতো দুরের কথা। কিন্তু নিরবে তাদের উপর অর্পীত দায়িত্ব তারা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মত দেশে যে প্রান্তেই কোন আউটব্রেক হয় সেখানেই তারা ছুটে যায়। ঘনবসতিপূর্ন দেশ হবার কারনে আমাদের দেশে অউটব্রেকের ঝুকি অনেক বেশি। বার্ড ফ্লু, নিপাহ ভাইরাসের মত বিভিন্ন আউটব্রেক দমানোর পেছনের মূল কৃতিত্ব তাদের। কিন্তু আমরা তাদের নামই জানি না।
মুলত আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবি এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এই কাজটি হচ্ছে। সিডিসি থেকে ট্রেনিং দেওয়া, বিভিন্ন পদ্ধতির সাথে পরিচিত হবার কারনে বাংলাদেশের সিডিসি এর মত ভূমিকা রেখে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। তাদের তৎপরতার জন্যই ২০০৯ এ ইনফ্লুয়েঞ্জা আউটব্রেক প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল। ন্যাশনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সেন্টার, বায়ো সেফটি ল্যাব ৩, নিপাহ ভাইরাস ডিটেকশন ল্যাবরটরি রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে। সম্প্রতি সুপার ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধে যথেষ্ঠ ভুমিকা ছিল আমাদের দেশের নাম না জানা এই প্রতিষ্ঠানটির।
সম্প্রতি আইইডিসিআর সিডিসি এর পদ্ধতির সহায়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত ৪০০ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বিশ্লেষন করে তারা ৬ টা সম্ভাব্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এবং এর প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
নিরবে সেবা দান করা এই প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সহযোগিতা করা ডাক্তারদের জন্যই আমাদের দেশে স্বাস্থ খাতের বিভিন্ন সূচকে ইন্ডিয়ার থেকেও শক্ত অবস্থানে রয়েছে। যেখানে নিপা ভাইরাস, বার্ড ফ্লু ইন্ডিয়ায় ভয়াবহ রকম ক্ষতি করতে সক্ষম্ হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশ খুব দ্রুত সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
এই প্রতিষ্ঠান কে আপনাদের কাছে পরিচিত করার জন্য এর আগেও একটি পোস্ট করেছিলাম। কিন্তু জানিনা কেন, এধরনের প্রতিষ্ঠান গুলি নিয়ে আমরা গর্ব করাতো দূরে থাক, এর সম্মন্ধে জানতেও ইচ্ছুক নই। আগের পোস্টেও রেস্পন্স পাইনি। আসল বিষয় হল আমাদের সবার উচিত আমাদের দেশের এরকম প্রতিষ্ঠান নিয়ে জানা। গর্ব করা। প্রচার করা। ভারতীয় দের যতই গালি দেন তারা তাদের দেশের প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করে। আর আমরা নিজেরাই নিজেদের কে গালি দিতে ব্যাস্ত থাকি।
.
Wasi Mahin